পরিমাপের মূলনীতি (Principle of Measurements)

একাদশ- দ্বাদশ শ্রেণি - পদার্থবিদ্যা - পদার্থবিজ্ঞান – ১ম পত্র | | NCTB BOOK
1

 আমরা জানি কোনো কিছুর মাপ-জোখের নাম পরিমাপ। পরিমাপ ছাড়া কোনো রাশি সম্মন্ধে সম্যক জ্ঞান লাভ করা সম্ভব নয়। প্রকৃত প্রস্তাবে পদার্থবিজ্ঞানের মূল ভিত্তি হলো বিভিন্ন রাশির পরিমাপ গ্রহণ। এজন্য পদার্থবিজ্ঞানকে পরিমাপবিজ্ঞান বলে।

 কোনো রাশি সম্বন্ধে আমরা দুভাবে জ্ঞান লাভ করতে পারি—একটি গুণগত ও অন্যটি পরিমাণগত। বস্তু ও শক্তির বৈশিষ্ট্যকে আমরা ইন্দ্রিয়াদির সাহায্যে অনুভব করতে পারি ও ভাষায় প্রকাশ করতে পারি। বস্তু ও শক্তি সম্বন্ধে এটাই আমাদের গুণগত জ্ঞান। কিন্তু এদের সম্বন্ধে পরিমাণগত জ্ঞান লাভ করতে হলেই পরিমাপের একান্ত প্রয়োজন এবং এই পরিমাপের জন্য মাপকাঠির আবশ্যক ।

কোনো একটি প্রাকৃতিক রাশি পরিমাপ করতে হলে তার একটি নির্দিষ্ট ও সুবিধাজনক অংশ বা খণ্ডকে আদর্শ (Standard) হিসেবে ধরে নিয়ে সেই রাশির পরিমাপ করা হয় এবং সর্বত্র ঐ নির্দিষ্ট অংশেরই প্রচলন করা হয়। পরিমাপের এই আদর্শকে ঐ রাশির একক বা মাপকাঠি বলে। 

যদি বলা হয় একটি কামরা 20 মিটার লম্বা, তবে আমরা বুঝি যে মিটার নামক একটি নির্দিষ্ট দৈর্ঘ্যকে আদর্শ হিসেবে ধরে নেয়া হয়েছে, যার তুলনায় কামরাটি 20 গুণ লম্বা। আবার যদি বলা হয় একটি বস্তুর ভর 10 কিলোগ্রাম, তবে বুঝতে হবে যে, কিলোগ্রাম নামক একটি নির্দিষ্ট ভরকে আদর্শ হিসেবে ধরে নেয়া হয়েছে যার তুলনায় বস্তুর মোট ভর 10 গুণ। সুতরাং একটি রাশির মধ্যে তার একক যতবার থাকবে সেই সংখ্যাই হবে ঐ রাশির মাপ নির্দেশক এবং যে কোনো রাশির পরিমাপ নিতে হলে দুটি জিনিসের প্রয়োজন। একটি হলো সংখ্যা, অপরটি হলো একক।

একটি ছাড়া অপরটি অর্থহীন। যেমন— রেশন ব্যাগে 10 কিলোগ্রাম চাউল আছে। এখানে ভর একটি রাশি, ‘10’ একটি সংখ্যা এবং "কিলোগ্রাম' একক। কিন্তু যদি বলা যায় রেশন ব্যাগে চাউলের ভর 10, তবে তার কোনো অর্থ হয় না। শুধু সংখ্যা দ্বারা রাশি প্রকাশ করা যায় না, এককও বলতে হয়। সুতরাং

রাশির মাপ = সংখ্যা x একক। এটিই হলো পরিমাপের মূলনীতি।

📚 পর্যবেক্ষণ ও পরীক্ষণের ক্রমবিকাশ এবং গুরুত্ব Successive Development of Observations and Experiments and their Importance

বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির যে সমৃদ্ধি আজ আমরা প্রত্যক্ষ করছি তা যুগে যুগে বিজ্ঞানীদের বিভিন্ন ক্ষেত্রে অবদানের ফসল। প্রাচীনকালে ভৌত বিজ্ঞানের বিকাশে গ্রিকদের একচ্ছত্র আধিপত্য ছিল। খেলেস (Thales খ্রি. পূ. 622-569) সূর্য গ্রহণ সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণীর জন্য বিখ্যাত। বিভিন্ন পর্যবেক্ষণে, উদ্ভাবনে এবং বিজ্ঞানের ক্রমবিকাশের অগ্রযাত্রায় যাদের অবদান চিরস্মরণীয় এমন কয়েকজন বরেণ্য বিজ্ঞানীদের অবদান সম্বন্ধে আলোচনা করা হলো। 

পিথাগোরাস (Pythagorous . পূ. 560-480 ) জ্যোতির্বিদ্যা, গণিত, শব্দবিজ্ঞান বিষয়ে অবদানের জন্য বিখ্যাত। তিনি এবং তাঁর অনুসারীরা বিশ্বাস করতেন যে, গাণিতিক সূত্রের সাহায্যে সবকিছুই প্রকাশ করা যেতে ...পারে। খ্রি. পূ. চতুর্থ শতকে ইউক্লিড (Euclid) জ্যামিতি ও আলোকবিজ্ঞানের অনেক মূল্যবান গবেষণা ল্য তথ্য প্রদান করেন।

আর্কিমিডিস (খ্রি. পূ. 287-212) :

খ্রি. পূ. তৃতীয় শতকে আর্কিমিডিস (Archimedes ) লিভারের নীতি ও উপস্থিতিবিদ্যার সূত্র আবিষ্কার করেন। তিনি গোলকীয় দর্পণের সাহায্যে সূর্য রশ্মি কেন্দ্রীভূত করে আগুন ধরানোর কৌশল উদ্ভাবন করেন।

বিজ্ঞানের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, আর্কিমিডিসের পরে কয়েক শতাব্দী বিজ্ঞানের তেমন কোনো উল্লেখযোগ্য উন্নতি হয় নি। এ সময়ে বিজ্ঞান চর্চায় এক ধরনের স্থবিরতা লক্ষ করা যায়।

আধুনিক বিজ্ঞানের ক্রমবিকাশের ধারা শুরু

গ্যালিলিও (Galileo 1564–1642): 

1589 খ্রিস্টাব্দে বিজ্ঞানী গ্যালিলিও (Galileo) মুক্তভাবে পড়ন্ত বস্তুর বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করে তিনটি সূত্র আবিষ্কার করেন। এগুলোকে পড়ন্ত বস্তুর সূত্র বলা হয়। তিনি স্থিতিবিদ্যা ও গতিবিদ্যার ওপর যথেষ্ট অবদান রাখেন।

1610 খ্রিস্টাব্দে বিজ্ঞানী গ্যালিলিও যৌগিক অণুবীক্ষণ যন্ত্র আবিষ্কার করেন। এই যন্ত্রের সাহায্যে অতি ক্ষুদ্র বস্তকে বহুগুণে বর্ধিত করে দেখা যায়। এটি সরল অণুবীক্ষণ যন্ত্র অপেক্ষা অধিক বিবর্ধন ক্ষমতার অধিকারী। গ্যালিলিও দূরবীক্ষণ যন্ত্রও আবিষ্কার করেন। 1610 খ্রিস্টাব্দে তিনি নব আবিষ্কৃত দূরবীক্ষণ যন্ত্র (Telescope) ব্যবহার করে বৃহস্পতি গ্রহের নক্ষত্রগুলো আবিষ্কার করেন। তিনি পানি উত্তোলনের যন্ত্র, বায়ু থার্মোস্কোপ আবিষ্কার করেন। সর্বকালের শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানী আইনস্টাইন গ্যালিলিওকে আধুনিক বিজ্ঞানের চমক হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন।

নিউটন (Newton, 1642-1727 ) :

বস্তু কেন মাটিতে পড়ে? মহাবিশ্বে সূর্য, চন্দ্র, গ্রহ, নক্ষত্র ইত্যাদির গতিবিধি সম্পর্কেও প্রাচীনকাল থেকেই মানুষের কৌতূহল ছিল। সপ্তদশ শতাব্দী পর্যন্ত মানুষের ধারণা ছিল যে বস্তুর মাটিতে পতিত হওয়া বস্তুর স্বাভাবিক ঘটনা। তিনি স্বর্গীয় বস্তুসমূহের গতিবিধি সম্পর্কে প্রথমে মতবাদ ব্যক্ত করেন। দ্বিতীয় শতাব্দীর দিকে গ্রিক জ্যোতির্বিদ টলেমি ভূ-কেন্দ্রিক তত্ত্ব উপস্থাপন করেন। এ তত্ত্ব অনুসারে স্থির পৃথিবীকে কেন্দ্র করে সূর্য, চন্দ্র, গ্রহ, নক্ষত্র আবর্তনরত। পঞ্চদশ শতাব্দীতে জ্যোতির্বিদ কোপারনিকাস 'সূর্য-কেন্দ্রিক' তত্ত্ব দেন। এই তত্ত্বে সূর্যকে মহাজগতের কেন্দ্রে স্থির বিবেচনা করা হয়েছে এবং অন্যান্য গ্রহ সূর্যকে কেন্দ্র করে আবর্তন করে। কোপারনিকাসের ধারণা ছিল গ্রহগুলোকে সূর্যের চারদিকে ঘুরতে বাধ্য করে চৌদকে বল। পঞ্চদশ শতাব্দীতে কেপলার গ্রহ-নক্ষত্রের গতিপথের বিভিন্ন উপাত্ত বিশ্লেষণ করে স্থির সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে, গ্রহগুলোর গতিপথ বৃত্তাকার নয়, উপবৃত্তাকার। 1658 খ্রিস্টাব্দে নিউটন বল সম্পর্কে ধারণা লাভের জন্য তার বিখ্যাত পরীক্ষাটি করেন। তিনি বাতাসের অনুকূলে ও প্রতিকূলে লাফ দিয়ে দূরত্বের পার্থক্য পর্যবেক্ষণ করেন। 1665 সালে ক্যামব্রিজে পড়ার সময় তিনি মহাকর্ষ বলের তত্ত্ব, ক্যালকুলাস ও আলোর বর্ণালী এই তিনটি সূত্র আবিষ্কার করেন।

গ্রহপুঞ্জের গতির মধ্যে কেপলার কিছু নিয়মনীতি খুঁজে পান এবং এই নিয়মনীতিগুলোকে তিনটি সূত্রের সাহায্যে প্রকাশ করেন। এগুলো কেপলারের সূত্র নামে পরিচিত। কিন্তু কোপারনিকাসের চৌম্বক বলের ধারণার সঙ্গে কেপলার কোনোভাবেই উপবৃত্তাকার প্রকল্প মিলাতে পারছিলেন না। সূর্যকে কেন্দ্র করে গ্রহগুলোর আবর্তন করার সন্তোষজনক কোনো কারণ তিনি দিতে পারেন নি। তাছাড়া একটি বস্তু কেন মাটিতে পতিত হয় তার ব্যাখ্যাও কেপলারের সূত্র" থেকে পাওয়া যায় না। এ সকল প্রশ্নের ব্যাখ্যা পাওয়া যায় 1687 খ্রিস্টাব্দে স্যার আইজ্যাক নিউটনের 'ফিলোসোফিয়া ন্যাচারালাস প্রিন্সিপিয়া ম্যাথমেটিকস' (Philosophiae Naturalis Principia Mathematics) গ্রন্থটি প্রকাশিত হওয়ার পর। এই বইয়ে বস্তুপিণ্ডগুলো কী করে চলাচল করে, গাণিতিক বিশ্লেষণসহ তার তত্ত্ব প্রকাশ করেন। এ ছাড়াও তিনি মহাকর্ষীয় বিধি উপস্থাপন করেন। তিনি দেখিয়েছিলেন যে উপবৃত্তাকার কক্ষে চন্দ্রের পৃথিবী প্রদক্ষিণ করার এবং সূর্যের চারদিকে গ্রহগুলোর উপবৃত্তাকার পথে ভ্রমণের কারণও এই মহাকর্ষ।

 আলোকবিদ্যা ও গণিতেও নিউটনের অবদান অপরিসীম। তিনি ক্যালকুলাস আবিষ্কার করেন। তিনি আলোর কণিকা তত্ত্বের প্রবক্তা। এই তত্ত্ব অনুযায়ী যেকোনো দীপ্ত বস্তু (Luminous body) হতে অনবরত অসংখ্য ক্ষুদ্র কণিকা ঝাঁকে ঝাঁকে নির্গত হয়। এই কণিকা তত্ত্বের সাহায্যে তিনি আলোর বিভিন্ন গুণাগুণ সম্পর্কীয় বিভিন্ন ঘটনা ব্যাখ্যা করতে সক্ষম হন। আলোর সরলপথে গমন, আলোর প্রতিফলন, প্রতিসরণ গুণাবলি এ তত্ত্বের সাহায্যে ব্যাখ্যা করা যায়। তাঁর অবদান এত সুদূরপ্রসারী যে সনাতনী পদার্থবিজ্ঞানকে নিউটনীয় পদার্থবিজ্ঞান বলে।

টমাস ইয়ং (Thomas Young, 1773-1829): 

নিউটনের কণিকা তত্ত্ব আলোর অনেক ঘটনা ব্যাখ্যা করতে পারে। তবে আলোর ব্যতিচার, অপবর্তন, সমবর্তন ইত্যাদির কোনো সন্তোষজনক ব্যাখ্যা কণিকা তত্ত্বে পাওয়া যায় না। স্যার আইজাক নিউটনের সমসাময়িক ডাচ বিজ্ঞানী হাইগেন্‌স (Huygens) 1678 খ্রিস্টাব্দে আলোর তরঙ্গ তত্ত্ব প্রদান করেন। পরে টমাস ইয়ং ফেনেলসহ আরও অনেকে এ তত্ত্বকে প্রতিষ্ঠিত করেন।

টমাস ইয়ং বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী ছিলেন। তিনি পেশায় একজন চিকিৎসক ছিলেন। বিজ্ঞানেও তাঁর অবদান অপরিসীম। তাঁর সবচেয়ে বেশি আগ্রহ ছিল আলোকবিজ্ঞানে। 

1801 খ্রিস্টাব্দে তিনি আলোকের ব্যতিচার আবিষ্কার করেন। দুটি উৎস হতে সমান কম্পাঙ্ক ও বিস্তারের দুটি আলোক তরঙ্গের উপরিপাতনের ফলে কখনও কখনও খুব উজ্জ্বল এবং কখনও কখনও অন্ধকার দেখায়। আলোকের এ ঘটনাকে ব্যতিচার বলে। 1807 খ্রিস্টাব্দে বিজ্ঞানী ইয়ং আলোকের ব্যতিচার প্রদর্শনের নিমিত্তে একটিপরীক্ষা সম্পাদন করেন। তাঁর নামানুসারে এই পরীক্ষাকে ইয়ং-এর পরীক্ষা বলে। এই পরীক্ষার ফলে আলোকের তরঙ্গ তত্ত্ব সুদৃঢ় হয়। পদার্থের স্থিতিস্থাপকতার উপরও তিনি একটি সূত্র প্রদান করেন। মানব চোখে বিভিন্ন আলোর সংবেদনশীলতা সম্মন্ধে তিনি সর্বপ্রথম ব্যাখ্যা প্রদান করেন। 

মাইকেল ফ্যারাডে (Michael Faraday, 1791-1867):

 মাইকেল ফ্যারাডে একজন পদার্থবিদ রসায়নবিদ ছিলেন। তিনি ইংল্যান্ডের রয়েল ইনস্টিটিউটের রসায়নবিদ্যার অধ্যাপক ছিলেন। 1845 খ্রিস্টাব্দে তিনি আবিষ্কার করেন যে একটি প্রবল চৌম্বকক্ষেত্রের প্রভাবে সমবর্তন তল ঘুরে যায়। এ ঘটনা ফ্যারাডে ক্রিয়া নামে পরিচিত। এই ক্রিয়া আবিষ্কারের পর বিজ্ঞানীরা ধারণা করলেন যে আলোকের সঙ্গে চুম্বকত্বের একটি গভীর সম্পর্ক রয়েছে। পরবর্তীকালে তিনি তড়িৎ চুম্বকীয় তরঙ্গতত্ত্ব আবিষ্কার করেন।

ফ্যারাডে তড়িৎ চুম্বকীয় আবেশ এবং আপেক্ষিক আবেশিক ধারকত্ব আবিষ্কারের জন্য অমর হয়ে আছেন। 1831 খ্রিস্টাব্দে তিনি আবিষ্কার করেন যে চৌম্বকক্ষেত্র দ্বারা তড়িৎ প্রবাহ সৃষ্টি করা যায়। এর নামই তড়িৎচৌম্বক আবেশ। এ আবিষ্কারকে ভিত্তি করে জেনারেটর, চাপফরমার ও অন্যান্য বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতি আবিষ্কৃত হয়েছে। আধুনিক সভ্যতা বিকাশে এ সমস্ত আবিষ্কার নিঃসন্দেহে যুগান্তকারী। এছাড়াও তিনি তড়িৎ বিশ্লেষণ, তড়িৎ বিশ্লেষণের সূত্র আবিষ্কার করেন। তড়িৎ প্রলেপন, তড়িৎ মুদ্রণ, ধাতু নিষ্কাশন, ধাতু বিশুদ্ধিকরণ ইত্যাদিতে তড়িৎ বিশ্লেষণ প্রক্রিয়া ব্যবহার করা হয়।

লর্ড রাদারফোর্ড (Lord Rutherford) :

ঊনবিংশ শতাব্দী পর্যন্ত বিজ্ঞানীদের ধারণা ছিল যে, প্রতিটি পরমাণু ধনাত্মক আধানের বস্তু দ্বারা গঠিত এবং এই ধনাত্মক আধানযুক্ত বস্তুর মাঝে ইতস্ততভাবে ঋণাত্মক আধানযুক্ত ইলেকট্রন ছড়িয়ে রয়েছে। প্রতিটি পরমাণুর মোট ধন আধান ও ঋণ আধানের পরিমাণ সমান। 

1911 সালে রাদারফোর্ড বিখ্যাত আলফা বিক্ষেপণ পরীক্ষার ফলাফল হতে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে, পরমাণুর সমস্ত ধন আধান এবং ভর এর কেন্দ্রে অতি অল্প পরিসর স্থানে কেন্দ্রীভূত রয়েছে। রাদারফোর্ড একে নিউক্লিয়াস নামে অভিহিত করেন, এই নিউক্লিয়াসের চারদিকে কতকগুলো ইলেকট্রন বৃত্তাকার কক্ষপথে ঘুরছে। ইলেকট্রনগুলোর ঘূর্ণনজনিত বল ও নিউক্লিয়াস এবং ইলেকট্রনগুলোর মধ্যে ক্রিয়াশীল কুলম্বীয় বল সমান ও বিপরীতমুখী হওয়ায় ইলেকট্রন সুস্থিরভাবে নির্দিষ্ট দূরত্বে নিউক্লিয়াসকে প্রদক্ষিণ করে। পরমাণুর এই মডেলকে সৌরজগতের সাথে তুলনা করা যায়। রাদারফোর্ডের পরমাণুর এই মডেল অন্যান্য মডেলের চেয়ে অধিকতর যুক্তিসঙ্গত হলেও এর সীমাবদ্ধতা ছিল যা পরবর্তীতে নীলস বোর দূর করেন।

আলবার্ট আইনস্টাইন ( Albert Einstein 1879-1955) :

আজ যদি বিশ্বের যেকোনো দেশের বিজ্ঞানমনস্ক কোনো ব্যক্তিকে জিজ্ঞেস করা হয়, “বিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে বিখ্যাত বিজ্ঞানী কে?” স্বাভাবিক উত্তর পাওয়া যাবে, “আলবার্ট আইনস্টাইন।" খুব কম সংখ্যক বিজ্ঞানাই আইনস্টাইনের মতো তাঁর মৌলিক কাজের সংখ্যা, বৈচিত্র্য এবং অপরিসীম গুরুত্ব বিবেচনায় এত বিখ্যাত হতে পেরেছেন। আইনস্টাইন তাঁর বহু বৈচিত্র্যময় বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের মধ্যে সবচেয়ে বেশি পরিচিত তাঁর আপেক্ষিক তত্ত্বের জন্য। আপেক্ষিক তত্ত্বের মধ্যে আপেক্ষিকতার বিশেষ তত্ত্বের জন্য তিনি সমধিক পরিচিত।

1905 সালে যখন তাঁর বয়স মাত্র 23 বছর তখন তিনি আপেক্ষিকতার বিশেষ তত্ত্ব প্রকাশ করেন। আমাদের মৌলিক চিন্তা-চেতনা বা বিশ্বাসের অনেক কিছুরই পরিবর্তন সাধন করেছে এই আপেক্ষিকতার বিশেষ তত্ত্ব। পারমাণবিক বিজ্ঞানের ক্রম বিকাশের ক্ষেত্রে আপেক্ষিক তত্ত্বের ভূমিকা অপরিসীম। আইনস্টাইনের মত অনুসারে স্থান, কাল, দৈর্ঘ্য, কোনোটিই পরম রাশি বা নিরপেক্ষ নয়। এগুলো পরিবর্তনশীল। চিরায়ত বলবিজ্ঞানে ভর এবং শক্তি স্বাধীন হলেও আপেক্ষিকতার বিশেষ তত্ত্ব অনুসারে এরা সমতুল্য (Equivalent)। এই তত্ত্ব অনুসারে আমরা জানতে পারি যে ভরসম্পন্ন কোনো বস্তুই আলোর বেগ বা তার বেশি বেগে ছুটতে পারে না, তা যত বলই বস্তুর উপর প্রয়োগ করা হোক না কেন।

আইনস্টাইনের আরেকটি অমর সৃষ্টি হচ্ছে আলোক তড়িৎ ক্রিয়া ব্যাখ্যা প্রদান। কোনো ধাতব পদার্থের উপর উপযুক্ত কম্পাঙ্ক বা তরজাদৈর্ঘ্যের আলোক আপতিত হলে ঐ পদার্থ হতে ইলেকট্রন নির্গত হয়। এই ক্রিয়াকে আলোক তড়িৎ ক্রিয়া বলে। 1905 খ্রিস্টাব্দে আলোক তড়িৎ ক্রিয়া ব্যাখ্যার জন্য আইনস্টাইন প্ল্যাঙ্কের কোয়ান্টাম তত্ত্ব প্রয়োগ করেন। কোয়ান্টাম তত্ত্ব অনুসারে যে কোনো বিকিরণ অসংখ্য ফোটনের সমষ্টি অর্থাৎ বিকিরণ ফোটনের একটি ঝাঁক বা ঝরনা। প্রতিটি ফোটনের শক্তি হচ্ছে hv। এখানে হলো প্ল্যাঙ্কের ধ্রুবক এবং হচ্ছে ফোটনের কম্পাঙ্ক। এখন একটি ফোটন কোনো ধাতব পাতের পরমাণুর উপর আপতিত হলো। ফোটনের সাথে পরমাণুর সংঘাত হবে এবংএই সংঘাত স্থিতিস্থাপক সংঘাত। এই সংঘাতের ফলে পরমাণুস্থ একটি ইলেকট্রন ফোটনের সমুদয় শক্তি গ্রহণ করবে এবং কোনো শক্তি স্থানান্তরিত হবে না। এখন ইলেকট্রনটি পরমাণুর নিউক্লিয়াসের সঙ্গে আবদ্ধ থাকায় এই শক্তির কিছু অংশ ইলেকট্রনকে নিউক্লিয়াসের আকর্ষণ হতে মুক্ত করতে ব্যয় হবে। অবশিষ্ট শক্তি নিয়ে ইলেকট্রন নির্গত হবে। এটিই আলোক তড়িৎ ক্রিয়ার ব্যাখ্যা।

ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক (Max Planck, 1858-1947) :

বিজ্ঞানী প্ল্যাঙ্ক ছিলেন জার্মানির প্রখ্যাত পদার্থবিদ। 1900. খ্রিস্টাব্দে তিনি তেজকণাবাদ আবিষ্কার করেন। বিখ্যাত বিজ্ঞানী স্যার আইজ্যাক নিউটন এবং সমকালীন বিজ্ঞানীরা বিশ্বাস করতেন যে আলো কণা প্রকৃতির। এই তত্ত্ব অনুযায়ী যে কোনো দীত বস্তু (Luminous body) হতে অনবরত অসংখ্য ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কণিকা ঝাঁকে ঝাঁকে নির্গত হয়। 1802 সালে আলোকের ব্যতিচারের ক্ষেত্রে ইয়ং-এর বিচিড় পরীক্ষা প্রমাণ করে যে আলো তরঙ্গ প্রকৃতির। আলোর বিভিন্ন ঘটনা বিশ্লেষণে ও ব্যাখ্যার সাফল্য এই তত্ত্বকে প্রতিষ্ঠিত করে। ইয়ং-এর পরীক্ষার প্রায় একশ বছর পরে ম্যাক্স প্ল্যাঙ্কে কৃষ্ণ বস্তুর বিকিরণ ব্যাখ্যায় আলোকের কণাতত্ত্ব পুনর্জীবিত করেন। এই প্রবন্ধ এবং অন্যান্য বিজ্ঞানীদের পরীক্ষালব্ধ ফলাফল থেকে এই ধারণা সৃষ্টি হয় যে আলো এবং সকল ধরনের তড়িৎ চৌম্বকীয় তরাই অতি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র শক্তিগুচ্ছের সমন্বয়ে গঠিত।

প্ল্যাঙ্কের অভিমত অনুসারে কোনো বস্তু হতে শক্তির বিকিরণ বা বিভিন্ন ধাতুর মধ্যে শক্তির বিনিময় নিরবচ্ছিন্নভাবে ঘটে না। এই প্রক্রিয়ায় কোনো ধারাবাহিকতা নেই। শক্তির নিঃসরণ বা শোষণ বিচ্ছিন্নভাবে খন্ড খন্ড আকারে বা এক একটি গুচ্ছ বা প্যাকেটে নির্গত বা শোষিত হয়। প্রতিটি শক্তিকণা বা শক্তিগুচ্ছ এক একটি অবিভাজ্য একক। তিনি শক্তির এ ক্ষুদ্র গুচ্ছের নাম দেন কোয়ান্টা (Quanta)। প্রতিটি কোয়ান্টার শক্তি বিকিরণ কম্পাঙ্কের সমানুপাতিক। এই শক্তি কোয়ান্টা পরবর্তীতে ফোটন হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। ফোটন বিদ্যুৎ নিরপেক্ষ এবং এর কোনো ভর নেই।

 

📚 ১.৯ পরিমাপে ভুল বা ত্রুটি

Errors in Measurements

কোনো ভৌত রাশির নির্ভুল পরিমাপ পেতে রাশির সাথে সম্পর্কযুক্ত যে সূত্র থাকে তার অন্তর্গত সকল রাশির মাপ নির্ভুল হওয়া প্রয়োজন। এর ব্যত্যয় ঘটলে পরিমাপ সঠিক হবে না। একে ভুল বা ত্রুটি বলে।

যেকোনো ভৌত রাশি পরিমাপে প্রকৃত শুদ্ধ মান পাওয়া যায় না। কিছু না কিছু ত্রুটি পরিলক্ষিত হয়। এ ত্রুটির উৎস পরীক্ষণ কাজে ব্যবহৃত বস্ত্রপাতির সূক্ষ্মভাবে রাশি পরিমাপের সীমাবন্ধতা এবং যিনি পরিমাপ করছেন পাঠ গ্রহণে তার ত্রুটির কারণ। এর অর্থ হলো যেকোনো পরিমাপ্য রাশির পরিমাপে একটি অনিশ্চয়তা বিদ্যমান থাকে। 

পরিমাপের ত্রুটিগুলোকে উৎপন্নের ধরন অনুযায়ী কয়েকটি ভাগে ভাগ করা যায়; যথা-

(১) যান্ত্রিক ত্রুটি (Instrumental errors)

(২) পর্যবেক্ষণমূলক বা ব্যক্তিগত ত্রুটি (Observational or personal) 

(৩) এলোমেলো বা অনিয়মিত ত্রুটি (Random errors) 

(৪) পুনরাবৃত্তিক বা নিয়মিত ত্রুটি (Systematic errors).

 

(১) যান্ত্রিক ত্রুটি (Instrumental errors) :

পরিমাপে যে সমস্ত যন্ত্র ব্যবহার করা হয়, সেগুলো সঠিক এবং সুবেদী না হলে কোনো ভৌত রাশির পরিমাপে ত্রুটি দেখা দেয়। একে যান্ত্রিক ত্রুটি বলে।

বিভিন্ন ধরনের যান্ত্রিক ত্রুটিগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো— শূন্য ত্রুটি (zero error), পিছট ত্রুটি (backlash error) ও লেভেল ত্রুটি (level error) |

শূন্য ত্রুটি (zero error) :

সাধারণত ভার্নিয়ার স্কেল, গজ, স্লাইড ক্যালিপার্স, ফেরোমিটার ইত্যাদির প্রধান স্কেলের '0' দাগ ভার্নিয়ার বা বৃত্তাকার স্কেলের '0' দাগের সাথে না মিলে আগে বা পিছনে থাকে। একে শূন্য ত্রুটি বলে।

পিছট ত্রুটি (backlash error):

 নাট-স্ক্রু নীতির উপর ভিত্তি করে যে সকল যন্ত্র তৈরি সেসব যন্ত্রে এ ত্রুটি পরিলক্ষিত হয়। নতুন যন্ত্রের তুলনায় পুরাতন যন্ত্রে এ ত্রুটি বেশি দেখা যায়। কারণ অনেকদিন ব্যবহারের ফলে নাটের গর্ত বড় হয়ে যেতে পারে বা স্কু ক্ষয় হয়ে আলগা হয়ে যায়, ফলে স্কুকে উভয় দিকে ঘুরালে সমান সরণ হয় না। এ ধরনের ত্রুটিকে পিছট ত্রুটি বলে। পাঠ নেওয়ার সময় যন্ত্রকে একই দিকে ঘুরালে এ ত্রুটি দূর হয়।

লেভেল ত্রুটি (level error) :

কতকগুলো পরীক্ষণের ক্ষেত্রে যন্ত্রকে ভালোভাবে লেভেলিং করে না নিলে সঠিক পাঠ পাওয়া যায় না। যেমন নিক্তি, বিক্ষেপ চৌম্বকমান , ট্যানজেন্ট গ্যালভানোমিটার ইত্যাদি। লেভেলিং এবং স্পিরিট লেভেলের সাহায্যে লেভেলিং করে নিতে হয়। 

(২) পর্যবেক্ষণমূলক বা ব্যক্তিগত ত্রুটি (Observational or personal errors) : 

পর্যবেক্ষকের পর্যবেক্ষণে ভুল এবং সঠিক মূল্যায়নের অভাবে এ ত্রুটি পরিলক্ষিত হয়। একে পর্যবেক্ষণমূলক ত্রুটি বা ব্যক্তিগত ত্রুটি বলে। দৃষ্টিভ্রষ্ট (Parallax error) এ ধরনের একটি ত্রুটি।

প্রতিকার (Remedy) :

 পর্যবেক্ষণ সতকর্তার সাথে করে এবং একাধিকবার পাঠ নিয়ে এ ত্রুটি দূর করা যায়। 

(৩) এলোমেলো বা অনিয়মিত ত্রুটি (Random errors) :

 জুটির বিভিন্ন বিষয়ে উপযুক্ত সাবধানতা অবলম্বন করা সত্ত্বেও কোনো একটি রাশির পাঠ বার বার ভিন্ন হতে দেখা যায়। পরিমাপে এ ধরনের ভিন্নতা বা পার্থক্য দুই ভাবে হতে পারে। যথা- (১) পর্যবেক্ষকের পর্যবেক্ষণের ত্রুটির জন্য হতে পারে কিংবা (২) পরীক্ষাকালে যন্ত্রের অবস্থার পরিবর্তনের জন্য। উদাহরণস্বরূপ, মাধ্যাকর্ষণজনিত ত্বরণ পরিমাপের ক্ষেত্রে T পরিমাপ করার জন্য থামা ঘড়ি (Stop watch) এবং L মাপার জন্য বেল এবং সূচক ব্যবহার করা হয়। T পরিমাপের জন্য যদি ঘড়িটি ঠিকমতো চালানো এবং থামানো না হয় তবে T-এর পরিমাপে ভুল হবে। L পরিমাপের সময় সূচক যদি স্কেলের একটি নির্দিষ্ট দাগের সাথে না মিলে দুইটি সন্নিহিত দাগের মধ্যে থাকে, তবে পর্যবেক্ষকের পক্ষে সূচকের অবস্থানের নির্ভুল মান স্কেল থেকে নেয়া সম্ভব হয় না। এ ধরনের ভুলগুলোকে অনিয়মিত বা এলোমেলো ত্রুটি বলে।

 প্রতিকার (Remedy) : 

অনিয়মিত ত্রুটি পরিবর্তনশীল। প্রাপ্ত পাঠ প্রকৃত পাঠ অপেক্ষা বেশি হলে ধনাত্মক এবং কম হলে ঋণাত্মক হবে। এই ত্রুটি দূর করতে হলে অধিক সংখ্যক পাঠ গ্রহণ করে তাদের গড় পাঠ বের করতে হবে।

(৪) পুনরাবৃত্তিক বা নিয়মিত ত্রুটি (Systematic errors) :

 পরীক্ষাকালে কোনো কোনো ত্রুটির ফলে পরীক্ষাধীন রাশির পরীক্ষালর মান সর্বদাই এবং নিয়মিতভাবে রাশিটির প্রকৃত মান অপেক্ষা কম বা বেশি হতে পারে। এ ধরনের ত্রুটিকে নিয়মিত বা পুনরাবৃত্তিক ত্রুটি বলে। মিটার ব্রিজের প্রান্তিক ত্রুটি, পোটেনশিওমিটারের প্রান্তিক ত্রুটি, স্ক্রুগজের শূন্য ত্রুটি এই ত্রুটির অন্তর্গত।

প্রতিকার (Remedy) : 

এই ত্রুটি সংশোধনের জন্য বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিভিন্ন অবস্থায় পরীক্ষাকার্যটি পুনরাবৃত্তি করা হয়।

পরম ত্রুটি (Absolute errors): কোনো একটি রাশির প্রকৃত মান ও পরিমাপকৃত মানের পার্থক্যকে পরম ত্রুটি বলে।

অতএব, পরম ত্রুটি = প্রকৃত মান – পরিমাপ্য মান

আপেক্ষিক ত্রুটি ও শতকরা ত্রুটি :

যেকোনো পরিমাপে পরম ত্রুটির চেয়ে আপেক্ষিক ত্রুটি বা শতকরা ত্রুটি অধিক গুরুত্বপূর্ণ ।

আপেক্ষিক ত্রুটি = পরম ত্রুটি/প্রকৃত মান

বা, SA =  এখানে গাণিতিক মান ৯ কে প্রকৃত মান হিসেবে ধরা হয়েছে।

শতকরা ত্রুটি প্রকাশ করা হয় নিম্নরূপে—

শতকরা ত্রুটি =   x100%

অন্যভাবে বলা যায় শতকরা ত্রুটি  = প্রকৃত মান - পরীক্ষালব্ধ/প্রকৃত মান x 100%

সামগ্রিক বা মোট ত্রুটি (Gross errors) : পর্যবেক্ষকের অসতর্কতা বা অমনোযোগিতার কারণে এ ত্রুটি পরিলক্ষিত হয়। সতর্কতার সঙ্গে পরীক্ষণ কর্ম সম্পাদন করে এ ত্রুটি দূর করা যায়।

 

 

Content added || updated By
Promotion